বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:৫৪ অপরাহ্ন
চিররঞ্জন সরকার:
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এখন তিন হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবেই দুই লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। কিন্তু প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি ব্যবস্থা দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে করোনা নিয়ে সরকারের কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে বলেও মনে হয় না। দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল। হাতে গোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া সেটাও বাস্তবায়িত হতে দেখা যাচ্ছে না। আর সেটা করার বাস্তবতা এখন আছে কি না, করলেও কতটুকু কী লাভ হবে, সেই সংশয় থাকছেই।
এদিকে দিন দিন নমুনা পরীক্ষাও কমে যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১২ হাজারের কাছাকাছি রয়েছে। যদিও জুন মাসে প্রতিদিন ১৭ হাজার করে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে রোগী শনাক্তের সংখ্যাও কমেছে। যদিও এখনো পরীক্ষার বিবেচনায় প্রতি চারজনে একজন কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আগে এই হার ছিল ২১ শতাংশের কাছাকাছি।
নমুনা পরীক্ষা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুস্থতার সংজ্ঞা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, যারা সুস্থ হয়ে গেছেন, তাদের দ্বিতীয়বার আর পরীক্ষা করানোর দরকার হচ্ছে না। এজন্য পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। পরীক্ষা করানোর জন্য মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক একটি ফি ধার্য করা হয়েছে। সে কারণেও পরীক্ষা কিছুটা কমতে পারে।
নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ার আরও নানা কারণ আছে। এর একটা হচ্ছে পরীক্ষা করার বিড়ম্বনা। অনেক মানুষ কয়েক দিন ঘুরে, সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেননি। ফলে এখন অনেকেই নমুনা পরীক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। লক্ষণ দেখা দিলে সতর্কতা অবলম্বন করে বাসাতেই থাকছেন।
বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার কারণেও মানুষের আস্থা কমে গেছে। পরীক্ষার ঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না মনে করে অনেকে নমুনা পরীক্ষা থেকে বিরত থাকছেন।
তা ছাড়া মানুষ তাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ কিছু লক্ষণ নিয়ে করোনার আত্মপ্রকাশ করছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা সেরেও যাচ্ছে। তাই অনেকেই হাসপাতাল, পরীক্ষা ইত্যাদি জটিলতায় যেতে চাচ্ছেন না। তা ছাড়া সামাজিক এই বিচ্ছিন্নতার ভয়ে অনেকে করোনার তথ্য গোপন করছেন। ফলে টেস্ট কমে যাচ্ছে। যদিও এতে সামাজিক বিপদ বাড়ছে। বিশেষ লক্ষণ ছাড়া রোগী ও লক্ষণ লুকানো রোগীর কারণে অনেকেই ঝুঁকিতে পড়ছেন। সংক্রমণের সংখ্যা এভাবেও বাড়ছে।
দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে গেলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে না। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ হলে কী করা হবে, দশ লাখ হলে কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, পনেরো লাখ বা তার বেশি হলেইবা কী করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। সরকার এখন পর্যন্ত জনমানসে একটি ধারণা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা হলো : অনেক উন্নত দেশ যেখানে করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত, সেখানে আমরা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো আছি। বাস্তবতা হলো, মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতা মাপার চেষ্টা করাটা নিতান্তই আহাম্মকি। তার চেয়েও বড় সত্যিটা হলো, করোনার ব্যাপারে আমাদের অবস্থা এখন সবে কলির সন্ধ্যায়! দেশে সংক্রমিতের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে কোনো ‘দৈব-দুর্বিপাক’ ছাড়া এই হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কেউ জানে না! তখন হয়তো স্বজন হারানোর শোকে পুরো বাংলাদেশই দিন-রাত কাঁদবে! তখন মন্ত্রী-এমপি-শিল্পপতিরাও রেহাই পাবেন না!
আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত করোনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো পরিকল্পনাহীনতা। ফুটবল মাঠে নামার আগেও কোচ ঠিক করে দেন, তার দলের খেলোয়াড়রা কোন ফরমেশনে খেলবেন। ৪-৪-২ বা ৩-৫-২… ফরমেশন, যা খুশি হতে পারে। মোদ্দা কথা একটাই, পরিকল্পনা। যারা মাঠে নামছেন, তারাও আগে থেকে জানেন, কে ডিফেন্স করবে। মাঝমাঠে কে থাকবে। উইং দিয়ে কে দৌড়াবে। আর ফাইনাল পাসটা কাকে দিতে হবে। তাই মাঠে নামার আগে পরিকল্পনার বিষয়টা অত্যন্ত জরুরি। ‘যে যেমন পারো ছুটে যাও’ মার্কা বালখিল্য ভাবনার কোনো জায়গা এখানে নেই। সেই পরিকল্পনাটা যত দ্রুত সম্ভব করা দরকার। আর এ ক্ষেত্রে কেবল আমলাদের ওপর নির্ভর না করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতগুলোও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।
সবার আগে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে হবে, করোনার সঙ্গে মানুষের পাশা খেলাটা একটা দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্রম হতে যাচ্ছে। মাথা ঠাণ্ডা করে, সংযম, শৃঙ্খলা আর অনুশাসনের মধ্যে আমাদের থাকতে হবে। সেভাবেই পরিকল্পনা করতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কী করতে হবে গোছের নিদান নয়, শৃঙ্খলা আনতে হবে ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে। বুঝে নেওয়া দরকার যে, স্বাভাবিক সমাজজীবন বলতে আমরা যা বুঝি, তা এখন ফিরবে না। অবশ্যই ভবিষ্যতে তা ফিরবে আবার, কিন্তু সেটা আগস্ট মাসে নয়। এমনকি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও নয়। কত দিন নয়, তা কারোই জানা নেই।
করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি ক্ষুধার বিরুদ্ধে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। ভাইরাস থেকে বাঁচার লড়াইয়ের পাশাপাশি খেতে পারার লড়াইটাও একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। খেতে না পারলে মানুষ রোগ-ব্যাধির ভয়কে তুচ্ছ মনে করবে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই খাদ্যের জোগান, রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হবে। মূল্যস্ফীতি, কাজের অভাব কিংবা ছাঁটাই, বণ্টনের অসাম্যে জর্জরিত আমাদের সমাজ ইতিমধ্যেই জর্জরিত। অবশ্যই এটা সারা বিশ্বের চিত্র, কিন্তু আমাদের সমস্যাটা মেটাতে হবে আমাদের মতো করে। আমাদের অবস্থা যেহেতু অন্যদের থেকে অনেক ভারসাম্যহীন, ঠুনকো, তাই মেরামতির প্রস্তুতিও ব্যাপকভাবে ‘যা আছে তাই দিয়ে’ই করা চাই। এটা মনে রাখা দরকার যে, বুভুক্ষু মানুষ লকডাউনের গুরুত্ব বোঝে না। সে বোঝে শুধু পেট। সবচেয়ে বড় কথা, এই লড়াই কারও একার কাজ হতে পারে না, সরকারকেই সবাইকে হেঁকে-ডেকে এ কাজে নামানো দরকার।
সংক্রমণ আর অসুস্থ মানুষকে চিহ্নিত করার কাজে প্রতিটা মানুষের সহযোগিতা যেমন সুনিশ্চিত করা দরকার, ঠিক তেমনই মানুষের একসঙ্গে পথ চলা, কথা বলার মধ্য দিয়ে আতঙ্ক কমতে পারে। ‘করোনা-আক্রান্ত’ এই ছাপ যেন আমাদের মানবিকতাকে সংকীর্ণ না করে। সংক্রমণ ধরা পড়লে কাউকে পাড়াছাড়া করা, ধারে-কাছে না যাওয়া, লাশের সৎকারে অংশ না নেওয়ার ঘটনা যেন আমাদের সমাজে আর না ঘটে। করোনা রোগীকে ‘অচ্ছুত’ মনে করলে এর ফল ভয়াবহ হবে, কারণ তাহলে মানুষ সমস্যা লুকিয়ে রাখতে আরও বেশি চেষ্টা করবেন। আমাদের দেশের বহু মানুষ ভবিষ্যতে সংক্রমিত হতে পারেন। আতঙ্কের বদলে সতর্কতাভিত্তিক ধারণাকে মজবুত করতে পারলে এই কাজে সফল হওয়া যাবে।
কিন্তু তেমন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা কোথায়? গত সাড়ে তিন মাস করোনার সঙ্গে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে লড়াই করে নিউজিল্যান্ড, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ যখন করোনা জয় করে সোল্লাসে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবন শুরু করছে, তখন আমরা ক্রমবর্ধমান আক্রান্ত ও মৃত্যুর মুখে দেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে লাল জোনগুলোতে কঠোর লকডাউন করব কী করব না, ঈদে গণপরিবহন চালাব কী চালাব না, সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারছি না। দ্বিধাদ্বন্দ্বে আটকে যাচ্ছে সিদ্ধান্ত।
লেখক-
লেখক ও কলামনিস্ট, chiros234@gmail.com